কোরবানির নিয়ম ও দোয়া মাসায়েল ঈদুল আযহা ২০২২

কোরবানির নিয়ম ও দোয়া মাসায়েল ঈদুল আযহা ২০২২ঃ আসন্ন কোরবানির ঈদে আমরা অনেকেই কুরবানী দেখতে চাই বা দিব। তাই আপনাদের জন্য কুরবানীর নিয়ম এবং কুরবানীর দোয়া এবং কুরবানীর মাসআলা সকল কিছু আলোচনা করব এই আর্টিকেলে। ঈদুল আযহা ২০২২। কুরবানীর অনেক নিয়মকানুন আছে যা আমরা অনেকেই জানি তারপরও মানিনা বা অনেকেই জানিনা।

আজকের আর্টিকেল কুরবানীর নিয়ম ও দোয়া মাহফিলে সম্পর্কে লেখা হয়েছে। আর্টিকেলটি একটু বড় হতে পারে তবে আপনাদের অনুরোধ করবো সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ার জন্য অনেকের অনেক কিছু জানার বা ডাউট থাকে সব কিছু ক্লিয়ার হয়ে যাবে এই আর্টিকেলে।

যাদের ওপর কোরবানি ওয়াজিব

কোরবানি ইসলামি শরিয়তের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। কোরআন ও হাদিসে এর গুরুত্ব অপরিসীম। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) হিজরতের পর প্রতি বছর কোরবানি করেছেন। তিনি কখনও কোরবানি পরিত্যাগ করেননি; বরং কোরবানি পরিত্যাগকারীদের ওপর অভিসম্পাত করেছেন।

হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি কোরবানি করল না, সে যেন আমার আমার ঈদগাহে না আসে।’

কোরবানির ফজিলতের ব্যাপারে হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে, হজরত যায়েদ ইবনে আকরাম থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, সাহাবায়ে কেরাম নবী করিম (সা.)-এর কাছে জিজ্ঞেস করেন, কোরবানি কী? নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেন, কোরবানি হলো তোমাদের পিতা হজরত ইবরাহিম (আ.) -এর সুন্নত।

এতে আমাদের সওয়াব কী? নবী করিম (সা.) বলেন, ‘কোরবানির পশুর প্রত্যেকটি পশমের বদলায় একটি করে সওয়াব রয়েছে। ভেড়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ভেড়ার প্রত্যেকটি পশমের বদলায়ও একটি করে সওয়াব রয়েছে।’ -মুসনাদে আহমাদ

হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘কোরবানির দিন কোরবানির চেয়ে উত্তম আমল নেই। কিয়ামতের দিন কোরবানির পশুকে শিং, পশম ও খুরসহ পেশ করা হবে এবং কোরবানির জন্তুর রক্ত মাটিতে পড়ার আগেই আল্লাহতায়ালার কাছে তা কবুল হয়ে যায়। তাই তোমরা খুব আনন্দ চিত্তে কোরবানি কর।’

কাদের ওপর কোরবানি ওয়াজিব

১০ জিলহজ ফজর থেকে ১২ জিলহজ সন্ধ্যা পর্যন্ত সময়ে যেসব প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থ মস্তিষ্ক, মুকিম ব্যক্তির কাছে নেসাব পরিমাণ সম্পদ থাকে অর্থাৎ স্বীয় হাজাতে আসলিয়্যাহ (পানাহার, বাসস্থান, উপার্জনের উপকরণ ইত্যাদি) ছাড়া অতিরিক্ত এ পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়, যা সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রৌপ্যের মূল্যের সমপরিমাণ (টাকার অঙ্কে আনুমানিক ৫৫ হাজার টাকা) হয়, সে ব্যক্তির ওপর কোরবানি করা ওয়াজিব।

এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনের অতিরিক্ত টাকা-পয়সা, সোনা-রুপা, অলংকার, বসবাস ও খোরাকির প্রয়োজনে আসে না এমন জমি, প্রয়োজনের অতিরিক্ত বাড়ি, ব্যবসায়িক পণ্য ও অপ্রয়োজনীয় সব আসবাবপত্র, পোশাক-আশাক, আসবাবপত্র, তৈজসপত্রও ধর্তব্য হবে। সে সম্পদের ওপর এক বছর অতিক্রম হওয়া শর্ত নয়।

পাগল ব্যক্তির কাছে নেসাব পরিমাণ সম্পদ থাকলেও তার ওপর কোরবানি ওয়াজিব হবে না।

মুসাফিরের ওপর কোরবানি ওয়াজিব নয়। মুসাফির ব্যক্তি কোরবানির দিনগুলো অতিবাহিত হওয়ার পর যদি বাড়ি ফিরে আসে, তাহলেও তার ওপর কোরবানির কাজা করা লাগবে না। -ফাতাওয়া কাজিখান ৩/৩৪৪; বাদায়েউস সানায়ে ৪/১৯৪; আদ্দুররুল মুখতার ৬/৩১৫

উল্লেখ্য যে, ৪৮ মাইল বা প্রায় ৭৮ কিলোমিটার দূরে যাওয়ার নিয়তে নিজ এলাকা ত্যাগ করে তাকে মুসাফির বলা হয়।

প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য নিজের পক্ষ থেকে কোরবানি করা ওয়াজিব। তার স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে ও বাবা-মায়ের পক্ষ থেকে কোরবানি করা ওয়াজিব নয়।

যার ওপর কোরবানি ওয়াজিব নয়, সে কোরবানির নিয়তে পশু ক্রয় করলে সে পশু কোরবানি করা তার ওপর ওয়াজিব হয়ে যায়।

যে ব্যক্তি প্রতি বছর নিজ প্রাপ্তবয়স্ক ছেলের পক্ষ থেকে কোরবানি করেন, তার জন্য নতুন করে অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন নেই।

যার ওপর কোরবানি ওয়াজিব, সে যদি কোনো কারণবশত কোরবানি না করে, তাহলে কোরবানির দিনগুলো চলে যাওয়ার পর একটি বকরির মূল্য সদকা করা ওয়াজিব।

কুরবানির পশু জবাইয়ের নিয়ম

জবাই করার সময় পশু ক্বিবলামুখী করে শোয়ানো। অতঃপর (بِسْمِ اللهِ اَللهُ اَكْبَر) বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার বলে জবাই করা।

ইচ্ছাকৃতভাবে বিসমিল্লাহ বলা পরিত্যাগ করলে জবাইকৃত পশু হারাম বলে গণ্য হবে। আর যদি ভুলবশত বিসমিল্লাহ ছেড়ে দেয় তবে তা খাওয়া বৈধ।

জবাই করার সময় কণ্ঠনালী, খাদ্যনালী, এবং উভয় পাশের দুটি রগ অর্থাৎ মোট চারটি রগ কাটা জরুরি। কমপক্ষে তিন যদি তিনটি রগ কটা হয় তবে কুরবানি শুদ্ধ হবে। কিন্তু যদি দু’টি রগ কাটা হয় তবে কুরবানি দুরস্ত হবে না। (হিদায়া)

জবাই করার সময় ছুরি ভালভাবে ধার দিয়ে নেয়া, যাতে জবাইয়ের সময় পশুর অপ্রয়োজনীয় কষ্ট না হয়। যেমন- এক ছুরি দিয়ে জবাই শুরু করে চামড়া কিছু কাটার পর আর না কাটা অতপর আবার ছুরি পরিবর্তন করে জবাই করা ইত্যাদি।

কোনো ব্যক্তি জবাই করার সময় জবাইকারীর ছুরি চালানোর জন্য সাহায্য করে, তবে তাকেও বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার বলা।

কোরবানির নিয়ম ও দোয়া মাসায়েল ঈদুল আযহা ২০২২

কুরবানির পশু জবাইয়ের দোয়া

কুরবানির পশু জবাই করার সময় মুখে (উচ্চ স্বরে) নিয়ত করা জরুরি নয়। অবশ্য মনে মনে নিয়ত এ নিয়ত করা যে, ‘আমি আল্লাহর উদ্দেশ্যে কুরবানি আদায় করছি। তবে মুখে দোয়া পড়া উত্তম।

কুরবানির পশু ক্বিবলার দিকে শোয়ানোর পর এ দোয়া পাঠ করা-

উচ্চারণ- ইন্নি ওয়াঝঝাহতু ওয়াঝহিয়া লিল্লাজি ফাতারাস সামাওয়াতি ওয়াল আরদা হানিফাও ওয়া মা আনা মিনাল মুশরিকিন। ইন্না সালাতি ওয়া নুসুকি ওয়া মাহইয়া ওয়া মামাতি লিল্লাহি রাব্বিল আলামিন। লা শারিকা লাহু ওয়া বি-জালিকা উমিরতু ওয়া আনা মিনাল মুসলিমিন। আল্লাহুম্মা মিনকা ও লাকা।

অতঃপর ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ বলে কুরবানির পশু জবাই করা।

কুরবানির পশু জবাই করে এ দোয়া পড়া-

উচ্চারণ : আল্লাহুম্মা তাকাব্বালহু মিন্নি কামা তাকাব্বালতা মিন হাবিবিকা মুহাম্মাদিও ওয়া খালিলিকা ইবরাহিমা আলাইহিমাস সালাতা ওয়াস সালাম।

লক্ষ্যণীয় হলো- যদি কেউ একাকি কুরবানি দেয় এবং নিজে জবাই করে তবে বলবে মিন্নি; আর অন্যের কুরবানির পশু জবাই করার সময় ‘মিন’ বলে যারা কুরবানি আদায় করছে তাদের নাম বলা।

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে উল্লেখিত নিয়মে কুরবানি আদায় করার তাওফিক দান করুন। সবার কুরবানিকে কবুল করুন। আমিন।

কোরবানির মাংস বন্টনের সঠিক নিয়ম

কোরবানি দেয়ার পর গরুর মাংস বন্টন করা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কোরবানির মাংস যদি সঠিকভাবে বন্টন করা না যায় তবে কোরবানি কবুলের শর্ত পূরণ হবে না। তাই মাংস বন্টনের ক্ষেত্রে সতর্ক হতে হবে।

কমবেশি সবারই জানা আছে, পশু কোরবানি করার পর মোট মাংসের তিনটি ভাগ করে এক ভাগ গরিব-দুঃখীকে, এক ভাগ আত্মীয়স্বজনকে এবং এক ভাগ নিজে খাওয়ার জন্য রাখতে হয়। তাই পশুটি কেনার সময় সুস্থ এবং বেশি মাংস সম্পন্ন হলে সব পক্ষই লাভবান হয়।

পশু কোরবানির ফলে অন্তর পরিশুদ্ধ হবে। আর এটাই হ’ল কোরবানির মূল প্রেরণা। আজকাল অনেকে গোশত জমা করে সেখান থেকে প্রতিবেশী ও ফকীর-মিসকীনদের কিছু কিছু দিয়ে বাকী গোশত পুনরায় নিজেদের মধ্যে বণ্টন করে নেন। এটি একটি কুপ্রথা। এর মাধ্যমে কৃপণতা প্রকাশ পায়। যা অবশ্যই পরিত্যাজ্য।

আসুন জেনে নেই কিভাবে বন্টন করবেন কোরবানির মাংস।

১. এর এক ভাগ গরিব-মিসকিনদের, এক ভাগ আত্মীয়-স্বজনকে এবং এক ভাগ নিজে খাওয়ার জন্য রাখতে হয়। কাজেই বেশি মাংসের জন্যে বড় আকারের পশু কেনা ভালো। নিজের কাছে এক ভাগের বেশি রাখা উচিত নয়। গরিব ও আত্মীয়-স্বজনদের মাঝে সমানভাগে ভাগ করা ভালো। তবে অবস্থাসম্পন্ন আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে না দিয়ে তা গরীব আত্মীয়দের দেয়া বেশি ভালো।

২. মাংস পরিমাপের ক্ষেত্রে দাড়িপাল্লা ব্যবহার করুন। তাহলে ভাগ যে সমান হলো তা নিশ্চিত করা যাবে।

৩. সবচেয়ে ভালো পশুর প্রতিটা অংশের মাংস, কলিজা ইত্যাদি একসঙ্গে মিশিয়ে ফেলা। তারপর তা সমান তিনভাগে ভাগ করা। তবে কোরবানির মাংস তিন ভাগে বন্টন মুস্তাহাব। আপনি চাইলে পুরোটাই বিলিয়ে দিতে পারেন। চাইলে পুরোটাই নিজের কাছে রাখা দোষের নয়। তবে গরীব, মিসকিন, আত্মীয়দের হক আছে এই মাংসে। কাজেই বিলিয়ে দিলেই মানসিক শান্তি মেলে।

৪. শুধু মাংস নয়, কোরবানির পশুর চামড়া বিক্রির টাকাতেও হক আছে গরীর মিসকিনদের। কাজেই আপনি এটা বিক্রি করে সেই টাকা দান করতে পারেন।

ভাগে কোরবানির নিময়কানুন

কেউ চাইলে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পক্ষ হয়ে কোরবানি করতে পারে। এছাড়া মৃত আত্মীয়-স্বজন, জীবিত আত্মীয়-স্বজনের পক্ষ থেকেও কোরবানি করা জায়েজ আছে।

যদি কেউ নিজের খুশিতে কোনো মৃত ব্যক্তির সওয়াব পৌঁছানোর উদ্দেশে কোরবানি করে, তবে তা জায়েজ আছে এবং ওই গোশত নিজেও খেতে পারবে এবং যা কে ইচ্ছা দিতেও পারবে।

যদি একটি গরুতে সাত জনের কম ৫/৬ জন শরিক হয় এবং কারো অংশ সাতভাগের কম না হয়; (যেমন, ৭০ হাজার টাকা দিয়ে গরু কিনলে কারো অংশে যেন দশ হাজার টাকা কম না হয়) তবে সবার কোরবানি জায়েজ হবে। আর যদি আট জন অংশীদার হয়, কবে কারো কোরবানি বৈধ হবে না।

যদি গরু কেনার আগে সাতজন অংশীদার হয়ে সবাই মিলে কেনে, তবে তা উত্তম, আর যদি কেউ একা একটি গরু কোরবানির জন্য কেনে এবং মনে মনে ইচ্ছা রাখে যে, পরে আরো লোক শরিক করে তাদের সঙ্গে মিলে কোরবানি করবে, তবে সেটাও জায়েজ আছে। কিন্তু যদি গরু কেনার সময় অন্যকে অংশীদার করার ইচ্ছা না থাকে, বরং একাই কোরবানির নিয়ত করে থাকে, কিন্তু পরে অন্যকে অংশীদার করতে চায়, এমতাবস্থায় যদি ওই ক্রেতা লোকটি গরিব হয় এবং তার ওপর কোরবানি ওয়াজিব না থাকে, তবে সে তার কেনা পশুতে এখন অন্য কাউকে অংশীদার করতে পারবে না, বরং একা একাই গরুটি কোরবানি করতে হবে (যার ওপর কোরবানি ওয়াজিবই হয়নি তার জন্য প্রযোজ্য)। আর যদি ওই ক্রেতা সম্পদশালী হয় এবং তার ওপর কোরবানি ওয়াজিব হয়ে থাকে, তবে ইচ্ছা করলে পরে অন্য অংশীদার নিতে পারবে।

যদি কোরবানির পশু হারিয়ে যায় এবং আরেকটি পশু দ্রুত কেনার পর যদি প্রথম পশুটি পাওয়া যায়, এমতাবস্থায় ক্রেতা যদি সম্পদশালী হয়, তবে যে কোনো একটি পশু কোরবানি করা ওয়াজিব হবে। আর যদি লোকটি গরিব হয়, তবে দু’টো পশুই কোরবানি করা তার ওপর ওয়াজিব হবে (যার ওপর কোরবানি ওয়াজিবই হয়নি তার জন্য প্রযোজ্য)।

কোরবানির পশু কেনার পর যদি সেটি বাচ্চা প্রসব করে, তবে ওই বাচ্চাটিকেও কোরবানি করে গরিব মিসকীনদের দিয়ে দেবে, নিজে খাবে না। তবে জবাই না করে সেটি কোনো গরিবকে দান করে দেওয়াও জায়েজ।

গর্ভবতী পশু কোরবানি করা জায়েজ আছে। যদি জবাই করার পর পেটের বাচ্চা জীবিত পাওয়া যায়, তবে সে বাচ্চাটিও জবাই করতে হবে।

সাতজন মিলে অংশীদার হয়ে যদি একটি গরু কোরবানি করে, তবে গোশত নিজেদের ধারণা অনুযায়ী ভাগ করা যাবে না। দাঁড়িপাল্লা দিয়ে মেপে সমান সমান ভাগ করা উচিত। অন্যথায় যদি ভাগের মধ্যে তারতম্য হয়ে যায়, তবে সুদ হয়ে যাবে এবং গোনাহগার হবে। অবশ্য যদি গোশতের সঙ্গে মাথা, পা বা চামড়াও ভাগ করে দেওয়া হয়, তবে যে ভাগে মাথা, পা, চামড়া থাকবে, সে ভাগে গোশত কম হলেও জায়েজ হবে, যত কমই হোক। কিন্তু যে ভাগে গোশত বেশি সে ভাগে মাথা, পা, বা চামড়া দিলে সুদের মতো হবে এবং গুনাহ হবে।

ছাগলের বয়স পূর্ণ এক বছরের কম হলে জায়েজ হবে না। এক বছর পূর্ণ হলে জায়েজ হবে। গরু, মহিষ দুই বছরের কম হলে কোরবানি জায়েজ হবে না। পূর্ণ দুই বছর হলে জায়েজ হবে। উট পাঁচ বছরের কম হলে জায়েজ হবে না। দুম্বা এবং ভেড়ার হুকুম ছাগলের মতো। কিন্তু ছয় মাসের বেশি বয়সের দুম্বার বাচ্চা এমন মোটাতাজা হয় যে এক বছরের দুম্বার পালে ছেড়ে দিলে সেটিকে আলাদা করে চেনা না যায়, তবে সেই দুম্বার বাচ্চাও কোরবানির জন্য জায়েজ আছে, অন্যথায় নয়। কিন্তু ছাগলের বাচ্চা যদি এরকম মোটা তাজাও হয়, তবুও এক বছর পূর্ণ না হলে কোরবানি জায়েজ হবে না।

যে পশুর চোখ দু’টি অন্ধ, অথবা একটি চোখ পূর্ণ অন্ধ বা একটি চোখের তিনভাগের একভাগ বা আরও বেশি দৃষ্টিশক্তি নষ্ট হয়ে গেছে, তবে সে পশুর কোরবানি জায়েজ নয়। এমনিভাবে যে পশুর একটি কানের বা লেজের এক তৃতীয়াংশ বা তার বেশি কেটে গেছে, সেটিও কোরবানির জন্য জায়েজ নয়।

যে পশু এমন খোঁড়া যে মাত্র তিন পায়ের ওপর ভর করে চলে, চতুর্থ পা মাটিতে লাগে না, অথবা মাটিতে লাগে বটে, কিন্তু তার ওপর ভর দিতে পারে না, এমন পশুর কোরবানি জায়েজ নয়। আর যদি খোঁড়া পায়ের উপরও ভর দিয়ে খুড়িয়ে চলে, তবে সেরকম পশুর কোরবানি জায়েজ আছে।

পশুটি যদি এমন জীর্ণ ও শুকনো হয় যে তার হাড়ের মধ্যের মগজও শুকিয়ে গেছে, তবে এমন পশুর কোরবানি জায়েজ নয়। হাড়ের ভেতরে মগজ যদি না শুকিয়ে থাকে, তবে কোরবানি জায়েজ আছে।

যে পশুর একটি দাঁতও নেই, এমন পশুর কোরবানি জায়েজ হবে না। আর যদি দাঁত পড়ে থাকে এবং অবশিষ্ট দাঁতের সংখ্যা যদি বেশি হয় তবে কোরবানি জায়েজ হবে।

যে পশুর জন্মলগ্ন থেকে কান নেই, সেটার কোরবানি জায়েজ নয়। কান আছে কিন্তু খুব ছোট, তবে সেটার কোরবানি জায়েজ।

যে পশুর জন্ম থেকে শিং হয়নি কিংবা শিং ছিল, কিন্তু ভেঙে গেছে, তবে এমন পশু দিয়ে কোরবানি জায়েয আছে। অবশ্য যদি একবোরে মূল থেকে ভেঙে যায়, তবে কোরবানি জায়েজ নয়।

যে পশুকে খাসি বানিয়ে দেওয়া হয়েছে, সে পশু দিয়ে কোরবানি জায়েজ আছে। এমনিভাবে যে পশুর গায়ে বা কাঁধে দাদ বা খুজলি হয়েছে সেটিরও কোরবানি জায়েজ। অবশ্য খুজলির কারণে যদি পশু একবোরেই জীর্ণ হয়ে থাকে, তবে কোরবানি জায়েজ হবে না।

ভালো পশু কেনার পর যদি এমন কোনো ত্র“টি দেখা দেয়, যার কারণে কোরবানি জায়েজ হয় না, তবে ওই পশুটি রেখে অন্য একটি পশু কিনে কোরবানি করতে হবে (যার ওপর কোরবানি ফরজ)। অবশ্য যার ওপর কোরবানি ওয়াজিব নয়, নিজেই আগ্রহ করে কোরবানি করার জন্য কেনে, সে ওই পশুই কোরবানি করবে। অন্য আরেকটি পশু কেনার প্রয়োজন নেই।

কোরবানির মাংস নিজে খাওয়া এবং নিজের পরিবারবর্গকে খাওয়ানোতে কোনো দোষ নেই। আত্মীয়-স্বজনকে হাদিয়া দেওয়া এবং গরিব মিসকীনকেও দান করা ভালো। কোরবানির মাংস ভাগের সর্বোত্তম পন্থা হলো- তিন ভাগ করে এক ভাগ গরিবদের দান করা, একভাগ আত্মীয়দের দেওয়া ও একভাগ নিজে রাখা। যদি কেউ এর চেয়েও কম বা বেশি করে তাতে গুনাহ হবে না।

কোরবানির চামড়া এমনিতেই দান করে দেওয়া মুস্তাহাব (ভালো)। কিন্তু যদি চামড়া বিক্রি করে, তবে এর মূল্য হিসেবে প্রাপ্য ওই টাকাটাই গরিবকে দান করতে হবে। ওই টাকা নিজে খরচ করে যদি অন্য টাকা দান করে, তবে আদায় হয়ে যাবে, কিন্তু অনুত্তম হবে।

কোরবানির চামড়ার দাম মসজিদ মেরামত বা অন্য কোনো নেক কাজে খরচ করা জায়েজ নয় বরং গরিবকে দান করতে হবে।

যদি চামড়া নিজের কাজে ব্যবহার করে যেমন, কিছু তৈরি করে, তবে এটাও জায়েজ আছে।

কোরবানির পশু জবাইকারী ও মাংস প্রস্তুতকারীর পারিশ্রমিক আলাদাভাবে দিতে হবে, কোরবানির মাংস, চামড়া, মাথা বা পা দিয়ে এর বিনিময় দেওয়া যাবে না।

কোরবানির পশুতে যদি কোনো পোশাক থাকে, তবে তা এবং সঙ্গে থাকা রশি বা দড়িও গরিবদের দান করতে হবে, নিজেদের কাজে লাগানো যাবে না।

গরিবের উপর কোরবানি ওয়াজিব নয়, কিন্তু যদি কোরবানির নিয়ত করে পশু কেনে, তবে তার নিয়তের কারণে সেই পশু কোরবানি করা ওয়াজিব হয়ে যাবে।

কারো কোরবানি ওয়াজিব ছিল, কিন্তু কোরবানির তিনটি দিনই চলে গেল অথচ কোরবানি করলো না। এমতাবস্থায় একটি বকরি বা ভেড়ার মূল্য দান করতে হবে। আর যদি বকরি কিনে থাকে, তবে ওই বকরিটিই দান করতে হবে।

যদি কেউ কোরবানির মান্নত করে এবং যে উদ্দেশে মান্নত করেছিল সেটা যদি পূর্ণ হয়, তবে গরিব হোক বা ধনী হোক, তার ওপর ওই কোরবানি করা ওয়াজিব হবে। কিন্তু মান্নতের কোরবানির গোশত গরিব মিসকীনের হক হবে, নিজে খাওয়া যাবে না। যদি নিজে খায় বা কোনো ধনীকে দেয়, তবে যে পরিমাণ খেয়েছে বা ধনীকে দিয়েছে সেই পরিমাণ পুনরায় গরিবদের দান করতে হবে।

ইউনিভার্সিটি অব ম্যাসাচুসেটসের প্রফেসর সুসান হুইটবর্ন বলেন, দেহের সবচেয়ে বড় অংশটি হলো আপনার পা। মনে অতিমাত্রায় দুশ্চিন্তা, অস্বস্তি এবং ভয় থাকলে পা কাঁপতে পারে।

কিন্তু যদি কোনো মৃত ব্যক্তি মৃত্যুর আগে অছিয়ত করে যায়, তবে সেই কোরবানির মাংস পুরোটাই দান করা ওয়াজিব হবে।

কারো অনুপস্থিতিতে যদি অন্য কেউ তার পক্ষ থেকে তার বিনা অনুমতিতে কোরবানি করে, তবে কোরবানি হবে না। আর যদি কোনো পশুর মধ্যে অনুপস্থিত ব্যক্তির অংশ তার বিনা অনুমতিতে সাব্যস্ত করে, তবে অন্যান্য অংশীদারের কোরবানিও হবে না।

যদি কোনো ছাগল কারো কাছে ভাগে বা প্রতিপালনের জন্য দেওয়া হয় এবং তার কাছ থেকে কিনে কেউ কোরবানি করে, তবে তার কোরবানি জায়েজ হবে না। কারণ, ওই লোক পশুর মালিক হয়নি। আসল মালিকই প্রকৃত মালিক। আসল মালিকের কাছ থেকে কিনলে তবে জায়েজ হবে। মাসআলা: যদি একটি গরু কয়েকজন মিলে কোরবানি করে এবং প্রত্যেকেই গরিব-মিসকীনকে বিলিয়ে দেওয়া বা রান্না করে খাওয়ানোর নিয়ত করে, তবে সেটাও জায়েজ আছে। অবশ্য যদি ভাগ করতে হয়, তবে দাঁড়িপাল্লায় সমান ভাগ করে নিতে হবে।

কোরবানির চামড়ার পয়সা পারিশ্রমকি হিসেবে দেওয়া জায়েজ নয়। কারণ, সেটা দান করে দেওয়া জরুরি।

কোরবানির পশুর বিবরণ

কোরবানি দিতে হবে গৃহপালিত চতুষ্পদ জন্তু দিয়ে। বন্য প্রাণী দিয়ে কোরবানি আদায় হবে না। ছাগল, ভেড়া, দুম্বা, গরু, মহিষ ও উট দ্বারা কোরবানি দেওয়া যায়। নর ও মাদা যে কোনো পশু দিয়ে কোরবানি হবে। তবে হিজড়া পশু দিয়ে কোরবানি হবে না। এ ছাড়া হরিণ ও বন্যগরু ইত্যাদি দিয়েও কোরবানি হবে না।

পশুর বয়স

ছাগল, ভেড়া ও দুম্বার নূন্যতম বয়স ১ বছর হতে হবে। গরু-মহিষের নূন্যতম বয়স ২ বছর। উটের নূন্যতম বয়স ৫ বছর।

কোরবানির পশুর সমস্যা থাকলে

কোরবানির পশু ত্রুটিমুক্ত ও সুন্দর হওয়া বাঞ্চনীয়। তবে সামান্য পরিমাণের ত্রুটি থাকলে তা দ্বারা কোরবানি হবে। তবে প্রাণীটি ত্রুটি থাকলে বা কোনো সমস্যা থাকলে কোরবানি হবে না নিম্নে কয়েকটি ক্রুটি তুলে ধরা হলোঃ

  • যদি পশুর একটি পা মাটিতে রাখতে না পারে বা মাটিতে রাখলেও তাতে ভর দিতে না পারে তবে ওই পশু দ্বারা কোরবানি হবে না।
  • যে পশু এতটাই অসুস্থ্য ও দুর্বল যে নিজ স্থান থেকে জবাইয়ের স্থান পর্যন্ত নিজে হেঁটে যেতে পারে না- তবে ওই পশু দিয়ে কোরবানি আদায় হবে না।
  • যে পশুর সবগুলো দাঁত পড়ে গেছে বা এত বেশি দাঁত পড়ে গেছে যে, সে খাদ্য চিবাতে পারে না- তা দ্বারা কোরবানি হবে না।
  • শিং যদি সমূলে উপড়ে যায় বা গোড়া থেকে এমনভাবে ভেঙে যায় যে, মাথার খুলি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে বা খুলির হাড় দেখা যায়- তবে তা দ্বারা কোরবানি করা যাবে না। অন্যথায় কোরবানি হবে। শিং না উঠে থাকলেও কোরবানি হবে বয়স হলে।
  • কান বা লেজের যদি অর্ধেক পরিমাণ বাকি থাকে তবে কোরাবানি হবে।
  • দুটি বা একটি চোখ সম্পূর্ণ দৃষ্টিহীন হলে কোরবানি দেওয়া যাবে না।

গর্ভবতী পশুর কোরবানি

গর্ভবতী প্রাণী কোরবানি দিলে কোরবানি হবে। তবে জেনে-শোনে এমনটি করা মাকরূহ। জবাইয়ের পর গর্ভস্থ বাচ্চা জীবিত পাওয়া গেলে তা দান করে দিতে হবে। আর মৃত বা অসম্পূর্ণ পাওয়া গেলে বাচ্চা ফেলে দিতে হবে। এতে কোরবানির কোনো ক্ষতি হবে না বা গোশত খেতেও কোনো সমস্যা নেই।

ক্রয়ের পর পশুতে ত্রুটি পরিলক্ষিত হলে

যদি এমন ত্রুটি দেখা দেয় যাতে কোরবানি চলবে না, তবে ক্রেতা ধনী হলে অন্য পশু দিয়ে কোরবানি দিবে। ত্রুটিযুক্ত পশু বিক্রি করলে করতে পারবে। আর গরিব হলে ত্রুটিযুক্ত এই পশু দিয়েই কোরবানি দিবে।

পশু ক্রয়ের পর পশু মারা গেলে

ক্রেতা ধনী হলে আরেকটি পশু কোরবানি দিতে হবে। আর গরিব হলে তার আর কোরবানি দিতে হবে না।

কোরবানির সঙ্গে আকিকা

গরু, মহিষ ও উট ইত্যাদিতে নিজের কোরবানির সঙ্গে সাত ভাগ মিল রেখে নিজের বা সন্তানদের আকিকার নিয়ত করা যাবে।

আকিকার নিয়তে অন্যদের কোরবানির সঙ্গেও শরিক হওয়া যাবে। তা নিয়ে একটি বিস্তারিত আর্টিকেল লিখবো তাই এখানে কিছু লেখা হয়নি।

জবাইকারী ও কসাইয়ের পারিশ্রমিক

তাদের ন্যায্য পারিশ্রমিক নিজের থেকে দিতে হবে। কোরবানি চামড়া বা গোশত দিয়ে তাদের পারিশ্রমিক আদায় করা জায়েয নেই। হ্যাঁ, নিজের থেকে ন্যায্য পারিশ্রমিক পরিপূর্ণ পরিশোধ করার পর উপহার হিসেবে গোশত, চামড়া দেওয়া যেতে পারে। গরিব হলে চামড়া বিক্রির টাকা দান করা যেতে পারে।

চামড়া, চর্বি, গোশত ও হাড় বিক্রি করা
কোরবানির পশুর কোনো অংশ নিজে বিক্রি করা নাজায়েয। নিজে ভোগ করা যায়, যে কাউকে উপহার দেয়া যায়। তবে কোনো কারণে বিক্রি করলে তা করতে হবে দান করার নিয়তে এবং বিক্রিলব্ধ সম্পূর্ণ টাকা জাকাত প্রদানের খাতে দান করতে হবে।

গোশত, চামড়া, চর্বি কাউকে উপহার দেওয়ার পর গ্রহীতা যদি নিজ প্রয়োজনে বা যে কোনো কারণে বিক্রি করে তা করতে পারবে। ফেলে দেওয়া হাড় অন্য কেউ কুড়িয়ে নিয়ে বিক্রি করলে করতে পারবে।

কুরবানির মাসআলা

১-কেউ চাইলে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পক্ষ হয়ে কোরবানি করতে পারে। এছাড়া মৃত আত্মীয়-স্বজন, জীবিত আত্মীয়-স্বজনের পক্ষ থেকেও কোরবানি করা জায়েজ আছে।

২- যদি কেউ নিজের খুশিতে কোনো মৃত ব্যক্তির সওয়াব পৌঁছানোর উদ্দেশে কোরবানি করে, তবে তা জায়েজ আছে এবং ওই গোশত নিজেও খেতে পারবে এবং যা কে ইচ্ছা দিতেও পারবে।

৩- কুরবানীর নেসাব পুরো বছর থাকা জরুরি নয়; বরং কুরবানীর তিন দিনের মধ্যে যে কোনো দিন থাকলেই কুরবানী ওয়াজিব হবে।-বাদায়েউস সানায়ে ৪/১৯৬, রদ্দুল মুহতার ৬/৩১২

৪- মোট তিনদিন কুরবানী করা যায়। যিলহজ্বের ১০, ১১ ও ১২ তারিখ সূর্যাস্ত পর্যন্ত। তবে সম্ভব হলে যিলহজ্বের ১০ তারিখেই কুরবানী করা উত্তম। -মুয়াত্তা মালেক ১৮৮, বাদায়েউস সানায়ে ৪/১৯৮, ২৩, ফাতাওয়া হিন্দিয়া ৫/২৯৫

৫- নাবালেগ শিশু-কিশোর তদ্রূপ যে সুস্থমস্তিষ্কসম্পন্ন নয়, নেসাবের মালিক হলেও তাদের উপর কুরবানী ওয়াজিব নয়। অবশ্য তার অভিভাবক নিজ সম্পদ দ্বারা তাদের পক্ষে কুরবানী করলে তা সহীহ হবে।-বাদায়েউস সানায়ে ৪/১৯৬, রদ্দুল মুহতার ৬/৩১৬

৬- যে ব্যক্তি কুরবানীর দিনগুলোতে মুসাফির থাকবে (অর্থাৎ ৪৮ মাইল বা প্রায় ৭৮ কিলোমিটার দূরে যাওয়ার নিয়তে নিজ এলাকা ত্যাগ করেছে) তার উপর কুরবানী ওয়াজিব নয়। -ফাতাওয়া কাযীখান ৩/৩৪৪, বাদায়েউস সানায়ে ৪/১৯৫, আদ্দুররুল মুখতার ৬/৩১৫

৭- দরিদ্র ব্যক্তির উপর কুরবানী করা ওয়াজিব নয়; কিন্তু সে যদি কুরবানীর নিয়তে কোনো পশু কিনে তাহলে তা কুরবানী করা ওয়াজিব হয়ে যায়। -বাদায়েউস সানায়ে ৪/১৯২

৮- কেউ যদি কুরবানীর দিনগুলোতে ওয়াজিব কুরবানী দিতে না পারে তাহলে কুরবানীর পশু ক্রয় না করে থাকলে তার উপর কুরবানীর উপযুক্ত একটি ছাগলের মূল্য সদকা করা ওয়াজিব। আর যদি পশু ক্রয় করে ছিল, কিন্তু কোনো কারণে কুরবানী দেওয়া হয়নি তাহলে ঐ পশু জীবিত সদকা করে দিবে।-বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৪, ফাতাওয়া কাযীখান ৩/৩৪৫

৯- কুরবানীর দিনগুলোতে যদি জবাই করতে না পারে তাহলে খরিদকৃত পশুই সদকা করে দিতে হবে। তবে যদি (সময়ের পরে) জবাই করে ফেলে তাহলে পুরো গোশত সদকা করে দিতে হবে। এক্ষেত্রে গোশতের মূল্য যদি জীবিত পশুর চেয়ে কমে যায় তাহলে যে পরিমাণ মূল্য হ্রাস পেল তা-ও সদকা করতে হবে।-বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০২, আদ্দুররুল মুখতার ৬/৩২০-৩২১

১০- উট, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা দ্বারা কুরবানী করা জায়েয। এসব গৃহপালিত পশু ছাড়া অন্যান্য পশু যেমন হরিণ, বন্যগরু ইত্যাদি দ্বারা কুরবানী করা জায়েয নয়। -কাযীখান ৩/৩৪৮, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৫

১১- যেসব পশু কুরবানী করা জায়েয সেগুলোর নর-মাদা দুটোই কুরবানী করা যায়। -কাযীখান ৩/৩৪৮, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৫

১২- উট কমপক্ষে ৫ বছরের হতে হবে। গরু ও মহিষ কমপক্ষে ২ বছরের হতে হবে। আর ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা কমপক্ষে ১ বছরের হতে হবে। তবে ভেড়া ও দুম্বা যদি ১ বছরের কিছু কমও হয়, কিন্তু এমন হৃষ্টপুষ্ট হয় যে, দেখতে ১ বছরের মতো মনে হয় তাহলে তা দ্বারাও কুরবানী করা জায়েয। অবশ্য এক্ষেত্রে কমপক্ষে ৬ মাস বয়সের হতে হবে।

১৩- ছাগলের বয়স ১ বছরের কম হলে কোনো অবস্থাতেই তা দ্বারা কুরবানী জায়েয হবে না। -কাযীখান ৩/৩৪৮, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৫-২০৬

১৪- একটি ছাগল, ভেড়া বা দুম্বা দ্বারা শুধু একজনই কুরবানী দিতে পারবে। এমন একটি পশু কয়েকজন মিলে কুরবানী করলে কারোটাই সহীহ হবে না। আর উট, গরু, মহিষে সর্বোচ্চ সাত জন শরীক হতে পারবে। সাতের অধিক শরীক হলে কারো কুরবানী সহীহ হবে না। -সহীহ মুসলিম ১৩১৮, মুয়াত্তা মালেক ১/৩১৯, কাযীখান ৩/৩৪৯, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৭-২০৮

১৫- সাতজনে মিলে কুরবানী করলে সবার অংশ সমান হতে হবে। কারো অংশ এক সপ্তমাংশের কম হতে পারবে না। যেমন কারো আধা ভাগ, কারো দেড় ভাগ। এমন হলে কোনো শরীকের কুরবানীই সহীহ হবে না। -বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৭

১৬- উট, গরু, মহিষ সাত ভাগে এবং সাতের কমে যেকোনো সংখ্যা যেমন দুই, তিন, চার, পাঁচ ও ছয় ভাগে কুরবানী করা জায়েয। -সহীহ মুসলিম ১৩১৮, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৭

১৭- যদি কেউ আল্লাহ তাআলার হুকুম পালনের উদ্দেশ্যে কুরবানী না করে শুধু গোশত খাওয়ার নিয়তে কুরবানী করে তাহলে তার কুরবানী সহীহ হবে না। তাকে অংশীদার বানালে শরীকদের কারো কুরবানী হবে না। তাই অত্যন্ত সতর্কতার সাথে শরীক নির্বাচন করতে হবে। -বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৮, কাযীখান ৩/৩৪৯

১৮- কুরবানীর গরু, মহিষ ও উটে আকীকার নিয়তে শরীক হতে পারবে। এতে কুরবানী ও আকীকা দুটোই সহীহ হবে।-তাহতাবী আলাদ্দুর ৪/১৬৬, রদ্দুল মুহতার ৬/৩৬২

১৯- শরীকদের কারো পুরো বা অধিকাংশ উপার্জন যদি হারাম হয় তাহলে কারো কুরবানী সহীহ হবে না।

২০- কুরবানীর পশু হারিয়ে যাওয়ার পরে যদি আরেকটি কেনা হয় এবং পরে হারানোটিও পাওয়া যায় তাহলে কুরবানীদাতা গরীব হলে (যার উপর কুরবানী ওয়াজিব নয়) দুটি পশুই কুরবানী করা ওয়াজিব। আর ধনী হলে কোনো একটি কুরবানী করলেই হবে। তবে দুটি কুরবানী করাই উত্তম। -সুনানে বায়হাকী ৫/২৪৪, ইলাউস সুনান ১৭/২৮০, বাদায়েউস সানায়ে ৪/১৯৯, কাযীখান ৩/৩৪৭

২১- কুরবানীর পশু নিজে জবাই করা উত্তম। নিজে না পারলে অন্যকে দিয়েও জবাই করাতে পারবে। এক্ষেত্রে কুরবানীদাতা পুরুষ হলে জবাইস্থলে তার উপস্থিত থাকা ভালো। -মুসনাদে আহমদ ২২৬৫৭, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২২২-২২৩, আলমগীরী ৫/৩০০, ইলাউস সুনান ১৭/২৭১-২৭৪

২২- অনেক সময় জবাইকারীর জবাই সম্পন্ন হয় না, তখন কসাই বা অন্য কেউ জবাই সম্পন্ন করে থাকে। এক্ষেত্রে অবশ্যই উভয়কেই নিজ নিজ যবাইয়ের আগে ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ পড়তে হবে। যদি কোনো একজন না পড়ে তবে ওই কুরবানী সহীহ হবে না এবং জবাইকৃত পশুও হালাল হবে না। -রদ্দুল মুহতার ৬/৩৩৪

২৩- কুরবানীর পশু কেনার পর বা নির্দিষ্ট করার পর তা থেকে উপকৃত হওয়া জায়েয নয়। যেমন হালচাষ করা, আরোহণ করা, পশম কাটা ইত্যাদি।সুতরাং কুরবানীর পশু দ্বারা এসব করা যাবে না। যদি করে তবে পশমের মূল্য, হালচাষের মূল্য ইত্যাদি সদকা করে দিবে।-মুসনাদে আহমদ ২/১৪৬, নায়লুল আওতার ৩/১৭২, ইলাউস সুনান ১৭/২৭৭, কাযীখান ৩/৩৫৪, আলমগীরী ৫/৩০০

২৪- কুরবানীর পশুর দুধ পান করা যাবে না। যদি জবাইয়ের সময় আসন্ন হয় আর দুধ দোহন না করলে পশুর কষ্ট হবে না বলে মনে হয় তাহলে দোহন করবে না। প্রয়োজনে ওলানে ঠান্ডা পানি ছিটিয়ে দেবে। এতে দুধের চাপ কমে যাবে। যদি দুধ দোহন করে ফেলে তাহলে তা সদকা করে দিতে হবে। নিজে পান করে থাকলে মূল্য সদকা করে দিবে। -মুসনাদে আহমদ ২/১৪৬, ইলাউস সুনান ১৭/২৭৭,

২৫- কুরবানীর গোশত তিনদিনেরও অধিক জমিয়ে রেখে খাওয়া জায়েয।-বাদায়েউস সানায়ে ৪/২২৪, সহীহ মুসলিম ২/১৫৯, মুয়াত্তা মালেক ১/৩১৮, ইলাউস সুনান ১৭/২৭০

২৬- শরীকে কুরবানী করলে ওজন করে গোশত বণ্টন করতে হবে। অনুমান করে ভাগ করা জায়েয নয়।-আদ্দুররুল মুখতার ৬/৩১৭, কাযীখান ৩/৩৫১

২৭- অন্যের ওয়াজিব কুরবানী দিতে চাইলে ওই ব্যক্তির অনুমতি নিতে হবে। নতুবা ওই ব্যক্তির কুরবানী আদায় হবে না। অবশ্য স্বামী বা পিতা যদি স্ত্রী বা সন্তানের বিনা অনুমতিতে তার পক্ষ থেকে কুরবানী করে তাহলে তাদের কুরবানী আদায় হয়ে যাবে। তবে অনুমতি নিয়ে আদায় করা ভালো।

২৮- পাগল পশু কুরবানী করা জায়েয। তবে যদি এমন পাগল হয় যে, ঘাস পানি দিলে খায় না এবং মাঠেও চরে না তাহলে সেটার কুরবানী জায়েয হবে না। -আননিহায়া ফী গরীবিল হাদীস ১/২৩০, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২১৬, ইলাউস সুনান ১৭/২৫২

২৯- কুরবানী ওয়াজিব এমন ব্যক্তিও ঋণের টাকা দিয়ে কুরবানী করলে ওয়াজিব আদায় হয়ে যাবে। তবে সুদের উপর ঋণ নিয়ে কুরবানী করা যাবে না।

৩০- যেসকল হাজী কুরবানীর দিনগুলোতে মুসাফির থাকবে তাদের উপর ঈদুল আযহার কুরবানী ওয়াজিব নয়। কিন্তু যে হাজী কুরবানীর কোনো দিন মুকীম থাকবে সামর্থ্যবান হলে তার উপর ঈদুল আযহার কুরবানী করা জরুরি হবে। -ফাতাওয়া হিন্দিয়া ৫/২৯৩, আদ্দুররুল মুখতার ৬/৩১৫, বাদায়েউস সানায়ে ৪/১৯৫, ইমদাদুল ফাতাওয়া ২/১৬৬

৩১- কুরবানী পশু জবাই করে পারিশ্রমিক দেওয়া-নেওয়া জায়েয। তবে কুরবানীর পশুর কোনো কিছু পারিশ্রমিক হিসাবে দেওয়া যাবে না। -কিফায়াতুল মুফতী ৮/২৬৫

৩২- কুরবানীর মৌসুমে অনেক মহাজন কুরবানীর হাড় ক্রয় করে থাকে। টোকাইরা বাড়ি বাড়ি থেকে হাড় সংগ্রহ করে তাদের কাছে বিক্রি করে। এদের ক্রয়-বিক্রয় জায়েয। এতে কোনো অসুবিধা নেই। কিন্তু কোনো কুরবানীদাতার জন্য নিজ কুরবানীর কোনো কিছু এমনকি হাড়ও বিক্রি করা জায়েয হবে না। করলে মূল্য সদকা করে দিতে হবে। আর জেনে শুনে মহাজনদের জন্য এদের কাছ থেকে ক্রয় করাও বৈধ হবে না। -বাদায়েউস সানায়ে ৪/২২৫, কাযীখান ৩/৩৫৪, ফাতাওয়া হিন্দিয়া ৫/৩০১

৩৩- ঈদুল আযহার দিন সর্বপ্রথম নিজ কুরবানীর গোশত দিয়ে খানা শুরু করা সুন্নত। অর্থাৎ সকাল থেকে কিছু না খেয়ে প্রথমে কুরবানীর গোশত খাওয়া সুন্নত। এই সুন্নত শুধু ১০ যিলহজ্বের জন্য। ১১ বা ১২ তারিখের গোশত দিয়ে খানা শুরু করা সুন্নত নয়। -জামে তিরমিযী ১/১২০, শরহুল মুনয়া ৫৬৬, আদ্দুররুল মুখতার ২/১৭৬, আলবাহরুর রায়েক ২/১৬৩

৩৪- কোনো কোনো এলাকায় দরিদ্রদের মাঝে মোরগ কুরবানী করার প্রচলন আছে। এটি না জায়েয। কুরবানীর দিনে মোরগ জবাই করা নিষেধ নয়, তবে কুরবানীর নিয়তে করা যাবে না। -খুলাসাতুল ফাতাওয়া ৪/৩১৪, ফাতাওয়া বাযযাযিয়া ৬/২৯০, আদ্দুররুল মুখতার ৬/৩১৩, ফাতাওয়া হিন্দিয়া ৫/২০০

কোরবানির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

কোরবানি : কোরবানি সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা নির্দেশ হচ্ছে, ‘নিশ্চয়ই (হে নবী!) আমি আপনাকে (নিয়ামত পূর্ণ) কাওসার দান করেছি, অতএব, আপনি আপনার ‘রব’ এর সন্তুষ্টির জন্যে সালাত কায়েম করুন ও তাঁর নামে কোরবানি করুন’ (সূরা আল কাওসার-১০৮/১-২)। রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও কোরবানি করবে না সে যেন ঈদগাহের নিকটে না আসে’ (আহমদ ও ইবনে মাজাহ)। হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (সা.) বলেছেন, কোরবানির দিনে মানবসন্তানের কোনো নেক আমলই আল্লাহ তায়ালার নিকট তত প্রিয় নয়, যত প্রিয় কোরবানি করা। কোরবানির পশুর শিং, পশম ও খুর কিয়ামতের দিন (মানুষের নেক আমলনামায়) এনে দেয়া হবে। কোরবানির পশুর রক্ত মাটিতে পড়ার আগেই তা আল্লাহর দরবারে পৌঁছে যায়। সুতরাং তোমরা আনন্দচিত্তে কোরবানি করো’ (তিরমিজি)।

কোরবানির অর্থ : আমাদের সমাজে বাংলায় প্রচলিত কোরবানি শব্দের অর্থ হচ্ছে, নিকটবর্তী হওয়া বা সান্নিধ্য লাভ করা। আল কুরআনে সূরা আল মায়েদার ২৭ নম্বর আয়াতে উল্লেখ আছে, ‘ইজ ক্কাররাবা-ক্কুরবা-নান’ অর্থাৎ যখন তার দু‘জনে কোরবানি পেশ করলো বা পশু জবাই করলো, বা জবাই করে ফেলে আসল। সূরা আল কাওসারে বলা হয়েছে, ‘ফাছল্লি লিরাববিকা ওয়ানহার’ অর্থাৎ অতএব, (হে নবী!) আপনার ‘রব’ এর স্মরণে সালাত আদায় করুন ও তাঁর সন্তুষ্টির জন্যে কোরবানি করুন’। এখানে ‘নাহার’ বলতে কোরবানি বোঝানো হয়েছে। আসলে ‘নাহার’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে, নহর, বিশেষ নিয়মে জবাই বা জবাই করা, জবাই করে হত্যা করা বা প্রিয় বস্তু জবাই করে হত্যা করা বা ত্যাগ করা।

কোরবানির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস : দুনিয়ায় মানব বসতির শুরুতেই কোরবানির প্রচলন শুরু হয়েছে। পৃথিবীর প্রথম মানুষ আমাদের আদি পিতা ও নবী হজরত আদম (আ.) এর প্রথম সন্তান কাবিল ছিল আল্লাহ তায়ালা ও পিতা-মাতার অবাধ্য বা কাফের। কাবিলের ছোট ভাই হজরত আদম (আ.) এর দ্বিতীয় ছেলে হাবিল ছিল আল্লাহভীরু ও মু’মেন। সে সময় আল্লাহ তায়ালার হুকুমে জোড়া জোড়া সন্তান হতো। একজন পুত্র ও একজন কন্যা সন্তান। আল্লাহ তায়ালার বিধান মতো প্রথম জোড়ার পুত্রের সাথে দ্বিতীয় জোড়ার কন্যার বিয়ে বৈধ ছিল। কাবিল আল্লাহ তায়ালার বিধান মানতে রাজি ছিল না। সে চেয়েছিল তার জোড়ার সুন্দরী বোনকেই বিয়ে করবে। শেষ পর্যন্ত তাদেও দু’জনকে কোরবানি পেশ করার নির্দেশ দেয়া হলো। আর বলা হলো যার কোরবানি কবুল করা হবে সে-ই প্রথম জোরার সুন্দরী বড় বোনকে বিয়ে করবে। এ ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালার ঘোষণা হচ্ছে,‘(হে নবী!) আপনি এদের কাছে আদমের দুই সন্তানের গল্পটি যথাযথভাবে শুনিয়ে দিন; গল্পটি ছিলো, যখন তারা দু‘জনে আল্লাহর নামে কোরবানি পেশ করলো, তখন তাদের মধ্যে একজনের (হাবিলের) কাছ থেকে কোরবানি কবুল করা হলো, আর একজনের (কাবিলের) কোরবানি কিছুতেই কবুল করা হলো না, (যার কোরবানি কবুল করা হয়নি) সে বললো আমি অবশ্যই তোমাকে (যার কোরবানি কবুল করা হলো তাকে) হত্যা করবো, সে (যার কোরবানি কবুল করা হলো) বললো, আল্লাহ তায়ালা তো শুধু পরহেজগার লোকদের কাছ থেকেই কোরবানি কবুল করে থাকেন’(সূরা আল মায়েদা-৫-২৭)।

আল্লাহ তায়ালার আইন অমান্য করার কারণেই পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম হত্যাকাণ্ড ঘটায় পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান আল্লাহর দ্বীনের শত্র“, দুনিয়ায় শয়তানের প্রথম শিকার কাফের ‘কাবিল’। পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম আল্লাহর আইন, বিধান বা দ্বীন অমান্য করা আর মানুষ হত্যার ঘটনা ঘটালো আল্লাহর দ্বীনের শত্র“ কাফের ‘কাবিল’। এটাই হচ্ছে নাস্তিক, কাফের ও শয়তানের কাজ, যা আল-কুরআনের সূরা আল মায়েদাসহ আরো কয়েকটি সূরায় উল্লেখ আছে। পৃথিবীতে কোরবানির ইতিহাস ও হত্যার ঘটনা এখান থেকেই শুরু হয়েছে।
আজকে মুসলিম সমাজে কোরবানির যে প্রচলন তা মূলত মুসলিম মিল্লাতের বা জাতির পিতা হজরত ইব্রাহীম (আ.) এর দেখানো পথ বা সুন্নাত। হজরত ইব্রাহীম (আ.) এর শতবর্ষ বয়সের পর আল্লাহ তায়ালা তাঁকে যে সন্তান দান করেছিলেন, তিনি আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে তাঁর সে কলিজার টুকরা হজরত ইসমাইল (আ.) এর কোরবানির সূত্র ধরে আজও কোরবানি প্রচলিত আছে।

হজরত ইব্রাহীম (আ.) এর কোরবানির সূত্রপাত : মুসলিম মিল্লাতের বা জাতির পিতা হজরত ইব্রাহীম (আ.) নমরুদ ও তার সাঙ্গো-পাঙ্গের অত্যাচারে আল্লাহ তায়ালার নির্দেশে তাঁর স্ত্রী হজরত সারাকে সাথে নিয়ে শাম দেশে হিজরত করলেন। দুর্ভাগ্যক্রমে সেখানকার বাদশাহ ছিলো জালিম ও ভীষণ বদলোক। বাদশাহর লোকেরা হজরত ইব্রাহীম (আ.) ও তাঁর সুন্দরী স্ত্রী হজরত সারার আগমনের সংবাদ বাদশাহর দরবারে পৌঁছে দিলে বাদশাহ তাদেরকে ধরে নিয়ে আসতে বলে। বাদশাহর লোকেরা হজরত ইব্রাহীম (আ.) ও তাঁর স্ত্রী সারাকে বাদশাহর দরবারে হাজির করে। বাদশাহ হজরত ইব্রাহীম (আ.) এর কাছে জানতে চায় তার সাথে স্ত্রী লোকটি কে? ইব্রাহীম (আ.) চিন্তা করলেন, স্ত্রী বললে হয়তো বা তাঁকে মেরে ফেলতে পারে, তাই তিনি বলেন, সে আমার দ্বীনি বোন। বাদশাহ হজরত ইব্রাহীম (আ.) কে বন্দী করে, আর হজরত সারাকে বাদশাহর বদস্বভাব চরিতার্থ করার জন্যে রেখে দেয়। বাদশাহর কু-প্রস্তাবে হজরত সারা রাজি নাহলে বাদশাহ তাঁকে হত্যার হুমকি দেয়। অতঃপর হজরত সারা দু’রাকা’আত সালাত আদায় করার অনুমতি চাইলে বাদশাহ তাঁকে সালাত আদায়ের ব্যবস্থা করতে দেয়। হজরত সারা সালাত শেষে আল্লাহ দরবারে ফরিয়াদ করেনÑ যেন আল্লাহ তায়ালা তাঁর সতীত্ব রক্ষা করেন। এরই মধ্যে বাদশাহ অত্যন্ত অসুস্থ ও দুর্বল হয়ে পড়ে। অবস্থা খারাপ দেখে আর বাদশাহর মৃত্যুর জন্য তার লোকেরা হজরত সারাকে দায়ী করবে ভেবে হজরত সারা বাদশাহর সুস্থতার জন্য দোয়া করেন। একে একে তিন বার একই ঘটনা ঘটলে বাদশাহ হজরত সারার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে। হজরত সারার সতীত্ব দেখে আর এক সতী নারী হজরত হাজেরাকে তাঁর দাসী হিসেবে দিয়ে তাঁদেরকে বিদায় করে দেয়।

হজরত সারা ও হজরত ইব্রাহীম (আ.) মুক্ত হয়ে সে দেশে বসবাস শুরু করেন। হজরত সারা তাঁর দাসী হজরত হাজেরাকে হজরত ইব্রাহীম (আ.) এর সাথে বিয়ে দেন। কারণ হজরত সারার বয়স তখন ৯০ বছর আর হজরত ইব্রাহীম (আ.) এর বয়স তখন ১০০ বছর। তাদের বিয়ের দীর্ঘ সময় পার হলেও তখনো হজরত সারা মা হতে পারেননি। তিনি ভাবলেন শেষ বয়সে যদি আল্লাহ তায়ালা মেহেরবানি করে তাঁর স্বামী হজরত ইব্রাহীম (আ.) কে কোনো সন্তান দান করেন। আল্লাহ তায়ালার মেহেরবানিতে এই হজরত হাজেরার গর্ভেই হজরত ইসমাইল (আ.)-এর জন্ম হয়।

হজরত ইসমাইল (আ.) এর জন্মের পর হজরত ইব্রাহীম (আ.) তাঁর স্ত্রী হজরত হাজেরা ও কলিজার টুকরা ছেলেকে আল্লাহতায়ালা নির্দেশে কাবা ঘরের নিকটবর্তী সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের পাদদেশে নির্জন স্থানে সামান্য খেজুর ও এক মসক পানিসহ রেখে আসেন। হজরত ইব্রাহীম (আ.) যখন তাঁদের এ অবস্থায় রেখে স্থান ত্যাগ করছিলেন, তখন হজরত হাজেরা প্রশ্ন করছিলেন, আপনি আমাদের এ নির্জন স্থানে রেখে চলে যাচ্ছেন ? হজরত ইব্রাহীম (আ.) ক্ষীণকন্ঠে জবাব দিয়েছিলেন, হ্যাঁ। আবারো হজরত হাজেরা প্রশ্ন করলেন এটা কি আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ ? হজরত ইব্রাহীম (আ.) আবারও জবাব দিয়েছিলেন, হ্যাঁ। হজরত হাজেরা আল্লাহ তায়ালার ওপর ভরসা করে তাঁর শিশু সন্তানকে নিয়ে সেখানে অবস্থান করলেন।

সে সময় কা’বা ঘরের তেমন কোনো চিহ্ন ছিলো না। কা’বা ঘরের ভিটিটি জমিন থেকে বেশ উঁচু ছিল। বৃষ্টির পানিতে সৃষ্ট বন্যায় চার পাশ ভেঙে গিয়েছিল। হজরত হাজেরা ও তাঁর সন্তানের খাদ্য ও পানীয় যখন শেষ হয়ে গেলো হাজেরা তখন খাদ্য ও পানির সন্ধানে সাফা ও মারওয়া পাহাড়ে দৌড়াদৌড়ি শুরু করেন। যখন নিরাশ হয়ে ফিরছিলেন তখন একটি আওয়াজ শুনতে পান। হাজেরা বলেন, কে আছো আমি তোমার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি সম্ভব হলে তুমি আমাকে আল্লাহর ওয়াস্তে একটু সাহায্য করো। হঠাৎ তিনি তাঁর শিশু পুত্র ইসমাইল (আ.) এর কাছে একজন লোক (ফেরেশতা) দেখতে পেলেন। সে (ফেরেশতা) তাঁর পায়ের গোড়ালি অথবা ডানা দ্বারা জমিনে আঘাত করলে অথবা হজরত ইসমাইল (আ.) এর কান্নাজনিত পায়ের গোড়ালির ঘর্ষণে নিচ থেকে পানির ফোয়ারা প্রবাহিত হতে লাগল। এ সেই ফোয়ারা বা কূপ যা বর্তমানে জমজম নামে বিশ্ব মুসলিমের কাছে পরিচিত। সুপেয় পানীয় হিসেবে পান করে পরিতৃপ্ত হন মুসলমানরা। তাও কা‘বাকে কেন্দ্র করে ও হজরত ইসমাইল (আ.) এর উছিলায় আল্লাহ তায়ালার করুণায় সৃষ্টি হয়েছে।

হাজেরা তাঁর মসক পূর্ণ করে নিলেন আর নিজেও তৃপ্তির সাথে পানি পান করলেন। এতে হজরত হাজেরার ক্ষুধা নিবারণ হল ও তাঁর শিশু পুত্রের জন্যে প্রয়োজনীয় দুধেরও ব্যবস্থা হলো। হজরত হাজেরার সাফা ও মারওয়া পাহাড়ে ক্রমাগত ৭ বার দৌড়াদৌড়ি করার কারণে সে ঘটনাকে কেন্দ্র করে আল্লাহ সোবহানাহু ওয়া তায়ালা হজ ও ওমরাহ পালনকারীদের জন্যে সাফা মারওয়া পাহাড়ে ৭ বার দৌড়াদৌড়ি করার বিধান জারি করেছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘অবশ্যই ‘সাফা ও মারওয়া’ পাহাড় দুটো আল্লাহ তায়ালার নিদর্শন সমূহের অন্যতম, অতএব, যদি তোমাদের মধ্যে কোনো লোক হজ বা ওমরা আদায় করার এরাদা করে তার জন্যে এই উভয় পাহাড়ের মাঝে তাওয়াফ করা বা দৌড়ানো দোষের কিছু নেই, কেননা যদি কোনো ব্যক্তি অন্তরে নিষ্ঠার সাথে কোনো ভালো কাজ করে তাহলে তারা যেন জেনে রাখে, নিঃসন্দেহে আল্লাহ তায়ালা কৃতজ্ঞতাপরায়ণ ও প্রভূত জ্ঞানের অধিকারী”(সূরা বাকারা-২-১৫৮)।

হজরত ইসমাইল (আ.) এর যখন হাঁটা-চলা ও খেলাধুলা করার বয়স তখন হজরত ইব্রাহীম (আ.) কে স্বপ্নে আদেশ করা হলো, তুমি তোমার প্রিয় বস্তু আল্লাহর নামে কোরবানি করো। ইব্রাহীম (আ.) স্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে ১০টি উট কোরবানি করলেন। পুনরায় তিনি আবারো একই স্বপ্ন দেখলেন। অতঃপর ইব্রাহীম (আ.) আবারো ১০০টি উট কোরবানি করলেন। আবারো তিনি একই স্বপ্ন দেখে ভাবলেন, আমার কাছেতো এ মুহূর্তে আমার কলিজার টুকরা প্রিয় পুত্র ইসমাইল (আ.) ছাড়া আর তেমন কোনো প্রিয় বস্তু নেই। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘অতঃপর আমি তাকে (হজরত ইব্রাহীম আ. কে) একজন ধৈর্যশীল পুত্র সন্তানের সুসংবাদ দান করলাম। সে যখন পিতার সাথে হাঁটা-চলার উপযোগী হলো, তিনি (ইব্রাহীম আ.) বললেন, হে আমার পুত্র! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, আমি তোমাকে কোরবানি করছি। সুতরাং তোমার মতামত কি? সে (হজরত ইসমাইল আ.) বললেন, হে আমার পিতা! আপনি যে বিষয়ে আদিষ্ট হয়েছেন তা পালন করুন। আপনি আমাকে আল্লাহর মেহেরবানিতে ধৈর্যশীলদের একজন পাবেন। অতঃপর যখন তাঁরা দু‘জন একমত হলো আর আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছার সামনে আত্মসমর্পণ করল এবং ইব্রাহীম (আ.) ইসমাইল (আ.) কে জবাই করার জন্যে কাত করে শুইয়ে দিলো; তখন আমি ইব্রাহীমকে ডাক দিয়ে বললাম, হে ইব্রাহীম, তুমি তোমার স্বপ্নকে সত্যে রূপ দিয়েছো। নিশ্চয়ই এটা ছিল ইব্রাহীম ও ইসমাইলের জন্যে একটা পরীক্ষা। অতঃপর আমি ইব্রাহীমকে দান করলাম একটি মহা কোরবানির পশু। অনাগত মানুষের জন্যে এ (কোরবানির) বিধান চালু রেখে, তাঁর স্মরণ আমি অব্যাহত রেখে দিলাম। শান্তি বর্ষিত হোক ইব্রাহীমের ওপর। আমি এভাবেই সৎপরায়ণ ব্যক্তিদের প্রতিদান দিয়ে থাকি।’ (সূরা আস সফফাত-১০১-১০৯)।

কোরবানির তাৎপর্য ও গুরুত্ব : হজরত জায়েদ ইবনে আরকাম (রা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, কতিপয় সাহাবা রাসূল (সা.) কে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল (সা.) কোরবানি কী? রাসূল (সা.) বললেন, কোরবানি মুসলিম মিল্লাতের বা জাতির পিতা ইব্রাহীম (আ.) এর সুন্নাত। তারা আবারো প্রশ্ন করলেন, এর মধ্যে আমাদের জন্যে কি আছে? রাসূল (সা.) বললেন, কোরবানির পশুর প্রতিটা পশমের বিনিময়ে একটি করে নেকি আছে। তারা বললেন, ভেড়ারতো অসংখ্য পশম আছে। রাসূল (সা.) বললেন, ভেড়ার প্রতিটি পশমের বিনিময়ে একটি করে নেকি দেয়া হবে, যদি তা খালেস নিয়তে কোরবানি করা হয়’(ইবনে মাজাহ)। আবু দাউদ শরীফের এক হাদিসে বর্ণিত আছে যে, রাসূল (সা.) বলেছেন, আল্লাহর নিকট সবচেয়ে মর্যাদার দিন হচ্ছে কোরবানির দিন।

কোরবানির শিক্ষা : কোরবানি কোনো চাপ বা জবরদস্তি বিষয় নয়। মানুষ স্বেচ্চায় তার প্রতিপালকের সন্তুষ্টি অর্জনের আশায় সবচাইতে প্রিয় বস্তু ত্যাগ করার মানসিকতা সৃষ্টি করে। যেমন হজরত ইব্রাহীম (আ.) শুধু মাত্র স্বপ্নে দেখেছেন, তোমার প্রিয় বস্তু আল্লাহর রাহে কোরবানি করো। আর অমনি তিনি তাঁর আদরের একমাত্র সন্তান হজরত ইসমাইল (আ.)কে কোরবানির জন্যে সম্পূর্ণভাবে প্রস্তুত ছিলেন। পৃথিবীতে মানুষের কাছে সবচাইতে আকর্ষণীয় বস্তুর মধ্যে অর্থ-সম্পদ বা টাকা-কড়ি আর সন্তান অন্যতম। এই অর্থ-সম্পদের মোহ ত্যাগের এ মানসিকতা সৃষ্টি করাই হচ্ছে কোরবানির শিক্ষা। কোরবানি আমাদের ঈমান ও তাকওয়া বৃদ্ধি করে ও পরকালের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করে। রাসূল (সা.) নির্দেশ করেছেন, হে লোকসকল তোমরা ত্র“টিমুক্ত ও উত্তম প্রাণি কোরবানি করো, কারণ কোরবানির এ পশুগুলো হবে তোমাদের জান্নাতে যাওয়ার বাহন’(বায়হাকি)।

কোরবানি সচ্ছল সব মুসলমানের ওপর ওয়াজিব। কোরবানির গোশতের ওপর আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, গরিব-মিসকিন ও মুসাফিরের হক আছে। খেয়াল রাখতে হবে সমাজের কোনো একজন ব্যক্তিও যেন কোরবানির গোশত থেকে বঞ্চিত না হয়। কিন্ত কোরবানির চামড়া শুধু মাত্র জাকাতের হকদারদেরই হক।

কোরবানির ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ : আমাদের সমাজে উট, গরু, মহিষ এ ধরনের পশু ৭ ভাগে কোরবানি করা হয়। এক্ষেত্রে সমমনা ও সম-আর্থিক সঙ্গতি সম্পন্ন লোকদেরই একত্রে কোরবানি করা উচিত। অনেকেই আবার কোরবানির পশুতে আকিকার জন্যে এক ভাগ বা দুই ভাগ রাখেন। এতে আকিকা সহিহ হবে না। আকিকার জন্যে ছেলে হলে দু‘টি ভেড়া বা বকরি আর মেয়ে হলে একটি ভেড়া বা বকরি নির্ধারণ করতে হবে। আর মনে রাখতে হবে কোরবানির সাথে আকিকার কোনো সম্পর্ক নেই। কোরবানি ঈদুল আজহার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ও ধনীর জন্যে এটা আনন্দ আর গরিবের জন্য স্বস্তির। (ইন্টারনেট)

আমাদের শেষ কথা

কুরবানীর অনেক নিয়মকানুন আছে যা আমরা অনেকেই জানি তারপরও মানিনা বা অনেকেই জানিনা। তাদের জন্যেই আজকের আরটিকেলটি লিখা হয়েছে। কোথাও কোন ভুল ত্রুটি হলে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন এবং তা আমাদেরকে অনুগত করবেন কমেন্ট বক্সে আমরা সংশোধন করার চেষ্টা করব। ধন্যবাদ সবাইকে।

Share the article..

Leave a Comment